Ads

কুরবানির মাসআলা , ইতিহাস ও তাৎপর্য


ছবি : সংগৃহিত


কুরবানির বিধান যুগে যুগে সব শরিয়তেই বিদ্যমান ছিল। মানব সভ্যতার সুদীর্ঘ ইতিহাসে প্রমাণিত যে, পৃথিবীর সব জাতি ও সম্প্রদায় কোনো না কোনোভাবে আল্লাহর দরবারে তার প্রিয় বস্তু উৎসর্গ করতেন। উদ্দেশ্য একটাই- আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি অর্জন।

আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আমি প্রত্যেক উম্মতেরজন্যে কুরবানির এক বিশেষ রীতি পদ্ধতি নির্ধারণ করে দিয়েছি, যেন তারা ওই সব পশুর ওপর আল্লাহর নাম নিতে পারে, যা আল্লাহ তাদেরকে দান করেছেন।’ (সুরা হজ : আয়াত ৩৪)                      


কুরবানি কি?

আরবি করব বা কুরবান (قرب বা قربان) শব্দটি উর্দূ ও ফার্সীতে (قربانى) কুরবানি নামে রূপান্তরিত। এর অর্থ হলো-নৈকট্য বা সান্নিধ্য। কুরআনুল কারিমের কুরবানির একাধিক সমার্থক শব্দের ব্যবহার দেখা যায়। 

نحر অর্থে,

আল্লাহ বলেন, فَصَلِّ لِرَبِّكَ وَانْحَرْ ‘সুতরাং আপনি আপনার প্রতিপালকের জন্য নামাজ এবং কুরবানি আদায় করুন। এ কারণে কুরবানির দিনকে يوم النحر বলা হয়।

 نسك অর্থে, 

আল্লাহ বলেন, قُلْ إِنَّ صَلاَتِيْ وَنُسُكِيْ وَمَحْيَايَ وَمَمَاتِيْ لِلّهِ رَبِّ الْعَالَمِيْنَ ‘আপনি বলুন, নিশ্চয় আমার নামাজ, আমার কুরবানি, আমার জীবন, আমার মৃত্যু; সবই বিশ্বজাহানের প্রতিপালক আল্লাহ তাআলার জন্য।’ (সুরা আনআ’ম : আয়াত ১৬২)

 منسك অর্থে, 

আল্লাহ বলেন, ‘ لِكُلِّ أُمَّةٍ جَعَلْنَا مَنْسَكاً ‘আমি প্রত্যেক উম্মাতের জন্য কুরবানির বিধান রেখেছি।’ (সুরা হজ্জ : আয়াত ৩৪)।

الاضحى অর্থে , 

হাদিসের ভাষায় কুরবানির ঈদকে (عيد الاضحى) ‘ঈদ-উল-আজহা’ বলা হয়।


কুরবানির গুরুত্ব  ফযীলত

কুরবানী একটি গুরুত্বপূর্ণ ইসলামী ইবাদত যা আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য পালন করা হয়। এর মাধ্যমে আমরা আল্লাহর প্রতি আমাদের আনুগত্য, ত্যাগের মানসিকতা এবং আমাদের সম্পদের বরকতের জন্য আল্লাহর নৈকট্য লাভের চেষ্টা করি। কুরবানীর এই গুরুত্ব ও ফযীলত মুসলিমদের জীবনে একটি বিশেষ স্থান দখল করে। এখানে কুরবানীর গুরুত্ব ও ফযীলত সম্পর্কে আলোচনা করা হলো:

কুরবানীর গুরুত্ব

  1. ইবাদতের রূপ: কুরবানী আল্লাহর নৈকট্য লাভের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। এটি প্রিয়বস্তুকে আল্লাহর পথে ত্যাগ করার মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য লাভের একটি মাধ্যম।

  2. ঈমানের পরীক্ষা: কুরবানী আমাদের ঈমানের পরীক্ষা। এটি প্রমাণ করে যে আমরা আল্লাহর আদেশ পালন করতে প্রস্তুত এবং আমাদের প্রিয়বস্তুকে তাঁর পথে ত্যাগ করতে পারি।

  3. ঐতিহ্য: কুরবানী একটি প্রাচীন ঐতিহ্য যা আমাদের প্রিয় নবী ইবরাহীম (আঃ) ও ইসমাইল (আঃ)-এর স্মৃতি বহন করে। তাঁদের ত্যাগের আদর্শ আমরা কুরবানীর মাধ্যমে স্মরণ করি।

কুরবানীর ফযীলত

  1. আল্লাহর নৈকট্য লাভ: হাদীসে বলা হয়েছে যে, কুরবানীর দিন আল্লাহর কাছে সবচেয়ে প্রিয় কাজ হলো কুরবানী করা। এটি আল্লাহর নৈকট্য লাভের একটি মাধ্যম।

  2. পাপ মোচন: রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, কুরবানীর পশুর রক্তের প্রথম ফোঁটা মাটিতে পড়ার সাথে সাথে আল্লাহ তা’আলা কুরবানীদাতার পাপসমূহ ক্ষমা করে দেন।

  3. ফেরেশতাদের সাক্ষী: কুরবানীর পশু জবাই করার সময় ফেরেশতারা উপস্থিত থাকেন এবং কুরবানীদানকারী ব্যক্তির পক্ষে সাক্ষ্য দেন।

  4. শ্রেষ্ঠ দান: হযরত আয়েশা (রাঃ) বর্ণনা করেছেন যে, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, “কুরবানীর দিন মানুষের কোন আমল আল্লাহর কাছে পশু কুরবানী করার চেয়ে বেশি প্রিয় নয়।”

  5. সম্পদে বরকত: কুরবানী সম্পদে বরকত আনে। এটি সম্পদের মঙ্গল করে এবং কুরবানীদাতা আল্লাহর নিকট থেকে পুরস্কৃত হন।


কার উপর কুরবানী ওয়াজিব

মাসআলা : প্রাপ্তবয়স্কসুস্থমস্তিষ্কসম্পন্ন প্রত্যেক মুসলিম নর-নারীযে ১০ যিলহজ্ব ফজর থেকে ১২ যিলহজ্ব সূর্যাস্ত পর্যন্ত সময়ের মধ্যে প্রয়োজনের অতিরিক্ত নেসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হবে তার উপর কুরবানী করা ওয়াজিব। টাকা-পয়সাসোনা-রূপাঅলঙ্কারবসবাস ও খোরাকির প্রয়োজন আসে না এমন জমিপ্রয়োজন অতিরিক্ত বাড়িব্যবসায়িক পণ্য ও অপ্রয়োজনীয় সকল আসবাবপত্র কুরবানীর নেসাবের ক্ষেত্রে হিসাবযোগ্য।

আর নেসাব হল স্বর্ণের ক্ষেত্রে সাড়ে সাত (৭.৫) ভরিরূপার ক্ষেত্রে সাড়ে বায়ান্ন (৫২.৫) ভরিটাকা-পয়সা ও অন্যান্য বস্তুর ক্ষেত্রে নিসাব হল- এর মূল্য সাড়ে বায়ান্ন তোলা রূপার মূল্যের সমপরিমাণ হওয়া। আর সোনা বা রূপা কিংবা টাকা-পয়সা এগুলোর কোনো একটি যদি পৃথকভাবে নেসাব পরিমাণ না থাকে কিন্তু প্রয়োজন অতিরিক্ত একাধিক বস্তু মিলে সাড়ে বায়ান্ন তোলা রূপার মূল্যের সমপরিমাণ হয়ে যায় তাহলেও তার উপর কুরবানী করা ওয়াজিব। -আলমুহীতুল বুরহানী ৮/৪৫৫ফাতাওয়া তাতারখানিয়া ১৭/৪০৫


কুরবানী করতে না পারলে

মাসআলা : কেউ যদি কুরবানীর দিনগুলোতে ওয়াজিব কুরবানী দিতে না পারে তাহলে কুরবানীর পশু ক্রয় না করে থাকলে তার উপর কুরবানীর উপযুক্ত একটি ছাগলের মূল্য সদকা করা ওয়াজিব। আর যদি পশু ক্রয় করেছিলকিন্তু কোনো কারণে কুরবানী দেওয়া হয়নি তাহলে ঐ পশু জীবিত সদকা করে দিবে। -বাদায়েউস সানায়ে ৪/২০৪ফাতাওয়া কাযীখান ৩/৩৪৫


কোন্ কোন্ পশু দ্বারা কুরবানী করা যাবে

মাসআলা :  উটগরুমহিষছাগলভেড়া ও দুম্বা দ্বারা কুরবানী করা জায়েয। এসব গৃহপালিত পশু ছাড়া অন্যান্য পশু যেমন হরিণবন্যগরু ইত্যাদি দ্বারা কুরবানী করা জায়েয নয়। -ফাতাওয়া কাযীখান ৩/৩৪৮বাদায়েউস সানায়ে ৪/২০৫


কুরবানীর পশুর বয়সসীমা

মাসআলা : উট কমপক্ষে ৫ বছরের হতে হবে। গরু ও মহিষ কমপক্ষে ২ বছরের হতে হবে। আর ছাগলভেড়া ও দুম্বা কমপক্ষে ১ বছরের হতে হবে। তবে ভেড়া ও দুম্বা যদি ১ বছরের কিছু কমও হয়কিন্তু এমন হৃষ্টপুষ্ট হয় যেদেখতে ১ বছরের মতো মনে হয় তাহলে তা দ্বারাও কুরবানী করা জায়েয। অবশ্য এক্ষেত্রে কমপক্ষে ৬ মাস বয়সের হতে হবে।

উল্লেখ্যছাগলের বয়স ১ বছরের কম হলে কোনো অবস্থাতেই তা দ্বারা কুরবানী জায়েয হবে না। -ফাতাওয়া কাযীখান ৩/৩৪৮বাদায়েউস সানায়ে ৪/২০৫-২০৬

মাসআলা : উটগরুমহিষ সাত ভাগে এবং সাতের কমে যেকোনো সংখ্যা যেমন দুইতিনচারপাঁচ ও ছয় ভাগে কুরবানী করা জায়েয। অর্থাৎ কুরবানীর পশুতে এক সপ্তমাংশ বা এর অধিক যে কোন অংশে অংশীদার হওয়া জায়েয। এক্ষেত্রে ভগ্নাংশ-  যেমনদেড় ভাগআড়াই ভাগসাড়ে তিন ভাগ হলেও কোনো সমস্যা নেই।  -সহীহ মুসলিমহাদীস ১৩১৮বাদায়েউস সানায়ে ৪/২০৭


কুরবানীর পশুতে আকীকার অংশ

মাসআলা : কুরবানীর গরুমহিষ ও উটে আকীকার নিয়তে শরীক হতে পারবে। এতে কুরবানী ও আকীকা দুটোই সহীহ হবে। -হাশিয়াতুত তাহতাবী আলাদ্দুর ৪/১৬৬রদ্দুল মুহতার ৬/৩৬২

মাসআলা : শরীকদের কারো পুরো বা অধিকাংশ উপার্জন যদি হারাম হয় তাহলে কারো কুরবানী সহীহ হবে না।

মাসআলা : যদি কেউ গরুমহিষ বা উট একা কুরবানী দেওয়ার নিয়তে কিনে আর সে ধনী হয় তাহলে ইচ্ছা করলে অন্যকে শরীক করতে পারবে। তবে এক্ষেত্রে একা কুরবানী করাই শ্রেয়। শরীক করলে সে টাকা সদকা করে দেওয়া উত্তম। -ফাতাওয়া কাযীখান ৩/৩৫০-৩৫১বাদায়েউস সানায়ে ৪/২১০


রুগ্ন ও দুর্বল পশুর কুরবানী

মাসআলা : এমন শুকনো দুর্বল পশুযা জবাইয়ের স্থান পর্যন্ত হেঁটে যেতে পারে না তা দ্বারা কুরবানী করা জায়েয নয়। -জামে তিরমিযী ১/২৭৫আলমগীরী ৫/২৯৭বাদায়েউস সানায়ে ৪/২১৪


দাঁত নেই এমন পশুর কুরবানী

মাসআলা : গরু-ছাগলের অধিকাংশ দাঁত না থাকলেও যে কয়টি দাঁত আছে তা দ্বারা যদি ঘাস চিবিয়ে খেতে পারে তবে সেটি দ্বারা কুরবানী সহীহ। কিন্তু দাঁত পড়ে যাওয়ার কারণে যদি ঘাস চিবিয়ে খেতে না পারে তবে ঐ পশু কুরবানী করা যাবে না। -বাদায়েউস সানায়ে ৪/২১৫ফাতাওয়া আলমগীরী ৫/২৯৮


যে পশুর শিং ভেঙ্গে বা ফেটে গেছে

মাসআলা : যে পশুর শিং একেবারে গোড়া থেকে ভেঙ্গে গেছেযে কারণে মস্তিষ্ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সে পশুর কুরবানী জায়েয নয়। কিন্তু শিং ভাঙ্গার কারণে মস্তিষ্কে যদি আঘাত না পৌঁছে তাহলে সেই পশু দ্বারা কুরবানী জায়েয। তাই যে পশুর অর্ধেক শিং বা কিছু শিং ফেটে বা ভেঙ্গে গেছে বা শিং একেবারে উঠেইনিসে পশু দ্বারা কুরবানী করা জায়েয। -জামে তিরমিযী ১/২৭৬সুনানে আবু দাউদহাদীস ৩৮৮বাদায়েউস সানায়ে ৪/২১৬রদ্দুল মুহতার ৬/৩২৪আলমগীরী ৫/২৯৭


কান বা লেজ কাটা পশুর কুরবানী

মাসআলা : যে পশুর লেজ বা কোনো কান অর্ধেক বা তারও বেশি কাটা সে পশুর কুরবানী জায়েয নয়। আর যদি অর্ধেকের কম হয় তাহলে তার কুরবানী জায়েয। তবে জন্মগতভাবেই যদি কান ছোট হয় তাহলে অসুবিধা নেই। -জামে তিরমিযী ১/২৭৫মুসনাদে আহমাদ ১/৬১০ইলাউস সুনান ১৭/২৩৮ফাতাওয়া কাযীখান ৩/৩৫২আলমগীরী ৫/২৯৭-২৯৮


মৃতের পক্ষ থেকে কুরবানী

মাসআলা : মৃতের পক্ষ থেকে কুরবানী করা জায়েয। মৃত ব্যক্তি যদি ওসিয়ত না করে থাকে তবে সেটি নফল কুরবানী হিসেবে গণ্য হবে। কুরবানীর স্বাভাবিক গোশতের মতো তা নিজেরাও খেতে পারবে এবং আত্মীয়-স্বজনকেও দিতে পারবে। আর যদি মৃত ব্যক্তি কুরবানীর ওসিয়ত করে গিয়ে থাকে তবে এর গোশত নিজেরা খেতে পারবে না। গরীব-মিসকীনদের মাঝে সদকা করে দিতে হবে। -মুসনাদে আহমাদ ১/১০৭হাদীস ৮৪৫ইলাউস সুনান ১৭/২৬৮রদ্দুল মুহতার ৬/৩২৬কাযীখান ৩/৩৫২


অন্য কারো ওয়াজিব কুরবানী আদায় করতে চাইলে

মাসআলা : অন্যের ওয়াজিব কুরবানী দিতে চাইলে ওই ব্যক্তির অনুমতি নিতে হবে। অনুমতি নিলে এর দ্বারা ওই ব্যক্তির কুরবানী আদায় হয়ে যাবে। নতুবা ওই ব্যক্তির কুরবানী আদায় হবে না। অবশ্য স্বামী বা পিতা যদি স্ত্রী বা সন্তানের বিনা অনুমতিতে তার পক্ষ থেকে কুরবানী করে তাহলে তাদের কুরবানী আদায় হয়ে যাবে। তবে অনুমতি নিয়ে আদায় করা ভালো।


গোশতচর্বি বিক্রি করা

মাসআলা : কুরবানীর গোশতচর্বি ইত্যাদি বিক্রি করা জায়েয নয়। বিক্রি করলে পূর্ণ মূল্য সদকা করে দিতে হবে। -ইলাউস সুনান ১৭/২৫৯বাদায়েউস সানায়ে ৪/২২৫কাযীখান ৩/৩৫৪আলমগীরী ৫/৩০১


বিদেশে অবস্থানরত ব্যক্তির কুরবানী অন্যত্র করা

মাসআলা : বিদেশে অবস্থানরত ব্যক্তির জন্য নিজ দেশে বা অন্য কোথাও কুরবানী করা জায়েয।

মাসআলা : কুরবানীদাতা এক স্থানে আর কুরবানীর পশু ভিন্ন স্থানে থাকলে কুরবানীদাতার ঈদের নামায পড়া বা না পড়া ধর্তব্য নয়বরং পশু যে এলাকায় আছে ওই এলাকায় ঈদের জামাত হয়ে গেলে পশু জবাই করা যাবে। -আদ্দুররুল মুখতার ৬/৩১৮


কুরবানীর পশুর হাড় বিক্রি

মাসআলা : কুরবানীর মৌসুমে অনেক মহাজন কুরবানীর হাড় ক্রয় করে থাকে। টোকাইরা বাড়ি বাড়ি থেকে হাড় সংগ্রহ করে তাদের কাছে বিক্রি করে। এদের ক্রয়-বিক্রয় জায়েয। এতে কোনো অসুবিধা নেই। কিন্তু কোনো কুরবানীদাতার জন্য নিজ কুরবানীর কোনো কিছু এমনকি হাড়ও বিক্রি করা জায়েয হবে না। করলে মূল্য সদকা করে দিতে হবে। আর জেনেশুনে মহাজনদের জন্য এদের কাছ থেকে ক্রয় করাও বৈধ হবে না। -বাদায়েউস সানায়ে ৪/২২৫কাযীখান ৩/৩৫৪ফাতাওয়া হিন্দিয়া ৫/৩০১


কাজের লোককে কুরবানীর গোশত খাওয়ানো

মাসআলা : কুরবানীর পশুর কোনো কিছু পারিশ্রমিক হিসাবে দেওয়া জায়েয নয়। গোশতও পারিশ্রমিক হিসেবে কাজের লোককে দেওয়া যাবে না। অবশ্য এ সময় ঘরের অন্যান্য সদস্যদের মতো কাজের লোকদেরকেও গোশত খাওয়ানো যাবে। -আহকামুল কুরআন জাস্সাস ৩/২৩৭বাদায়েউস সানায়ে ৪/২২৪আলবাহরুর রায়েক ৮/৩২৬ইমদাদুল মুফতীন পৃ. ৮০২


জবাইকারীকে পারিশ্রমিক দেওয়া

মাসআলা : কুরবানীর পশু জবাই করে পারিশ্রমিক দেওয়া-নেওয়া জায়েয। তবে কুরবানীর পশুর কোনো কিছু পারিশ্রমিক হিসেবে দেওয়া যাবে না। -কিফায়াতুল মুফতী ৮/২৬৫


কুরবানির ইতিহাস

আদম (আ.) থেকে শুরু করে মুহাম্মদ (সা.) পর্যন্ত, সব নবী-রাসুল ও তাদের অনুসারীরা কোরবানি করেছেন। কোরআনুল কারিম থেকে আমরা জানতে পারি আদম (আ.)-এর দুই পুত্র হাবিল ও কাবিলের মাধ্যমে কোরবানির সূত্রপাত হয়। সে ইতিহাস আমরা কোরআন থেকে জানার চেষ্টা করব ইনশাআল্লাহ। 

আল্লাহতায়ালা বলেন, হে রাসুল আপনি তাদের কাছে আদমের দুপুত্রের সংবাদ পাঠ করে, সত্যতার সঙ্গে শুনিয়ে দিন, যখন তারা উভয়ে কোরবানি করল একজনের কোরবানি কবুল করা হয়েছিল, কিন্তু অন্যজনের হয়নি। এক ভাই বলল, আমি অবশ্যই তোমাকে হত্যা করব, অন্য ভাই বলল, আল্লাহতায়ালা মুত্তাকিদের পক্ষ থেকে কোরবানি কবুল করেন। (সুরা আল মায়িদা, আয়াত : ২৭)

আমরা সুরা মায়েদার ২৭ নম্বর আয়াতের তাফসির ও সংশ্লিষ্ট ঘটনা পড়লে বুঝতে পারব, ইতিহাসের প্রথম কোরবানির সঠিক ও বিস্তারিত বিষয় : আদম (আ.)-এর দুপুত্র হাবিল ও কাবিলের ঘটনাটি বিশুদ্ধ ও শক্তিশালী সনদসহ বর্ণিত হয়েছে, ঘটনার বিবরণ হলো যখন হজরত আদম (আ.) পৃথিবীতে আগমন করেন এবং প্রজনন ও বংশবিস্তার আরম্ভ হয় তখন প্রতি গর্ভ থেকে একটি পুত্র ও একটি কন্যা এরূপ যমজ সন্তান জন্মগ্রহণ করত। তখন ভ্রাতা ও ভগিনী ছাড়া আদমের আর কোনো সন্তান ছিল না। অথচ ভ্রাতা ও ভগিনী পরস্পর বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হতে পারে না। 

তাই আল্লাহতায়ালা বাস্তব প্রয়োজনের খাতিরে আদম (আ.)-এর শরিয়তে এ নির্দেশ জারি করেন যে, একই গর্ভ থেকে যে যমজ পুত্র ও কন্যা জন্মগ্রহণ করবে তারা পরস্পর সহোদর ভ্রাতাণ্ডভগিনী গণ্য হবে। তাদের মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্ক হারাম হবে। কিন্তু পরবর্তী গর্ভ থেকে জন্মগ্রহণকারী পুত্রের জন্য প্রথম গর্ব থেকে জন্মগ্রহণকারিনী কন্যা সহোদর ভ্রাতা ভগিনী হিসেবে গণ্য হবে না। তাদের পরস্পর বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হওয়া বৈধ হবে।

ঘটনাক্রমে কাবিলের সহজাত সহোদরা বোন ছিল সুন্দরী, আর হাবিলের সহজাত সহোদরা বোন ছিল কুশ্রী, যা কাবিলের ভাগ্যে পড়ল। এতে কাবিল অসন্তুষ্ট হয়ে হাবিলের শত্রুতে পরিণত হলো। সে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করল যে, আমার সহজাত বোনকেই আমার সঙ্গে বিবাহ দিতে হবে, হজরত আদম (আ.) তার শরিয়তের বিধান ঠিক রাখার জন্য প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলেন। 

অতঃপর তিনি কাবিল-হাবিলের মধ্যে বিরাজমান বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য বললেন তোমরা উভয়ই আল্লাহর সন্তুষ্টির নিমিত্তে কোরবানি পেশ করো। যার কোরবানি কবুল হবে সে সুন্দরী মেয়ের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হবে। আদম (আ.) নিশ্চিত বিশ্বাস ছিল যে, সত্যপন্থির কোরবানিই গ্রহণযোগ্য হবে। 

শুধু আদম (আ.) নয়, আল্লাহর নবী হজরত নূহ (আ.), হজরত ইয়াকুব (আ.), হজরত মুসা (আ.) সব নবীর উম্মতের ওপর কোরবানি ছিল। 

মুসলিম জাতির পিতা ইব্রাহিম আলাইহিস সাল্লাম, আল্লাহর প্রেমে, স্বীয় পুত্রকে কোরবানি করার মহাপরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে এক অবিস্মরণীয় ইতিহাস সৃষ্টি করেন। 

সাড়ে ৫ হাজার বছর আগে সবচেয়ে প্রিয় বস্তু ত্যাগের জন্য আদিষ্ট হন ইবরাহিম (আ.) আল্লাহতায়ালা বলেন, অতঃপর ইসমাইল (আ.) যখন তার পিতার সঙ্গে কাজ করার মতো বয়স উপনীত হলো তখন ইবরাহিম (আ.) বলল, হে বৎস আমি স্বপ্নে দেখি যে, তোমাকে আমি জবেহ করছি, এখন তোমার অভিমত কী? সে বলল, হে আমার আব্বাজান আপনি যা আদিষ্ট হয়েছেন তাই করুন, আল্লাহ চাইলে আপনি আমাকে ধৈর্যশীল সন্তান হিসেবে দেখতে পাবেন। (সুরা সফফাত আয়াত : ১০৩)

হজরত ইসমাইল আলাইহিস সালাম নিজের জানকে আল্লাহর রাহে উৎসর্গ করতে নির্দ্বিধায় সম্মত হয়ে আত্মত্যাগের বিস্ময়কর দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। ইবরাহিম আলাইহিস সালামের প্রতি এটা ছিল আল্লাহর পরীক্ষা, তাই পিতার ধারালো অস্ত্র দিয়ে সন্তান ইসমাইল (আ.)-এর একটি পশমও কাটতে পারেনি, পরে আল্লাহর হুকুমে জান্নাতের একটি দুম্বা জবাই হয়। পৃথিবীর বুকে এটাই ছিল স্রষ্টার প্রেমে সর্বশ্রেষ্ঠ আত্মত্যাগের উদাহরণ। অনুপম দৃষ্টান্তকে চিরস্মরণীয় করে রাখার জন্য উম্মতি মুহাম্মাদির জন্য কোরবানি করাকে ওয়াজিব করেছেন। 

পবিত্র কোরআনে হাকিমে রাব্বুল আলামিন বলেন, আল্লাহর কাছে পৌঁছায় না তোমাদের কোরবানির গোশত এবং রক্ত বরং পৌঁছায় তোমাদের তাকওয়া। (আয়াত নম্বর : ৩৭)

রাসুল (সা.) বলেন, কোরবানির দিন রক্ত প্রবাহিত করার চেয়ে প্রিয় কোনো আমল আল্লাহর কাছে নেই, কিয়ামতের দিন কোরবানির পশু প্রত্যেকটি লোম, ক্ষুর, পশম ইত্যাদি নিয়ে আল্লাহর কাছে উপস্থিত। রক্ত জমিনে পতিত হওয়ার আগেই তা আল্লাহর কাছে বিশেষ মর্যাদায় পৌঁছে যায়। (তিরমিজি) 

কোরবানির পরিত্যাগকারীর ওপর বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু ওয়াসাল্লাম কঠোর সতর্কবার্তা পেশ করেছেন, বলেন সামর্থ্য আছে তার পরও কোরবানি করল না, সে যেন আমাদের ঈদগাহের ধারেকাছেও না আসে। (মিশকাত)

মুসলমানদের শুধু কোরবানির প্রতীক হিসেবে পশু জবাইয়ের মাধ্যমে সীমাবদ্ধ থাকলে চলবে না, বিশ্ব মানবতার মুক্তি ও বিশ্ব মুসলমানদের কল্যাণের জন্য সবাইকে নিবেদিতপ্রাণ হতে হবে। মানুষের অন্তর থেকে পাশবিক চিন্তা-চেতনাকে  বিসর্জন দিতে হবে।

প্রতি বছর কোরবানি পশু হনন করতে আমাদের মধ্যে আসে না, বরং কোরবানির মাধ্যমে পশু প্রবৃত্তিকে বিসর্জন দিয়ে, আল্লাহকে সন্তুষ্টি করার এটি যে একটি উত্তম মাধ্যম তা পুরো মুসলিম মিল্লাতকে স্মরণ করিয়ে দিতে ঈদুল আজহা প্রতি বছর ফিরে আসে। 

ঈদুল আজহা আমাদের শেখায়, মালিকের কাছে নিজেকে বিলিয়ে দাও! মাথা নত করে দাও! কোরবান করে দাও সব সাধ-আহ্লাদ! নিজের সুখগুলো ভাগ করে দাও গরিব-অসহায় সব মানুষের হাতে! ঈদুল আজহার আনন্দ ছড়িয়ে পড়ুক সবখানে, সবার মনে, সবার ঘরে। ঈদ মোবারক। তাকাবালাল্লাহু মিন্না ও মিনকুম।

তথ্যসূত্র : Collected & Edited from Google , Chatgpt, Monthly Magazine : Al- Kawsar

Post a Comment

0 Comments